:: S A N G B A D . C O M . B D ::

পাকিস্তানে আহমদীদের নির্বিচারে হত্যা
প্রতিবাদে আহমদীয়া সমপ্রদায়ের সংবাদ সম্মেলন ও কিছু কথা 


মাহমুদ আহমদ সুমন

গত ৫ জুন আহমদীয়া মুসলিম জামা'ত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকার ৪নং বকশীবাজার লাইব্রেরি কক্ষে পাকিস্তানের লাহোরে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের ওপর জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে আহমদীয়া সমপ্রদায়ের নেতারা বলেন, আজকে বাংলাদেশের আহমদীয়াদের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোন আক্রমণের বিষয় নয় বরং পাকিস্তানের লাহোরে গত ২৮ মে, ২০১০ তারিখে দুটি আহমদীয়া মসজিদে জুমার নামাজ চলাকালীন পরিচালিত বর্বর ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী আক্রমণের বিষয়ে কিছু বলার জন্য আমরা এই যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছি। গত ২৮ মে পবিত্র জুমার দিন জুমার নামাজ আদায় করার জন্য আহমদীয়ারা লাহোরের দারুয যিকর ও বায়তুন নূর মসজিদে সমবেত ছিলেন। খুতবা চলাকালে কয়েকজন ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী অতর্কিতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে এবং স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মসজিদে প্রবেশ করে এবং আহমদীয়া মুসলিম জামাত, লাহোরের আমির ও মসজিদের ইমামসহ ৯৪ জনকে শহীদ ও ১২৫ জনকে গুরুতর আহত করে। এই উগ্র-ধর্মান্ধদের তা-ব আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে থাকে। এরই মধ্যে তারা নিজেদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে মসজিদের মূল হল ঘরে আহত অবস্থায় পড়ে থাকা মুসলি্লদের বেছে বেছে গুলি করে হত্যা করে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রাপ্ত ভিডিও চিত্রে আমরা দেখেছি, মৃত্যু পথযাত্রী আহত আহমদীয়া বুজুর্গরা কীভাবে দরুদ শরিফ ও দোয়া পড়তে পড়তে তাদের প্রভুর কাছে ফিরে গেছেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন)। যারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তাদের অনেকে বিকলাঙ্গ ও পঙ্গু জীবনযাপন করবেন আর নিকট আত্মীয়স্বজন হারানোর বেদনা বহন করে জীবন কাটাচ্ছেন অনেক আহমদীয়া। আমরা অর্থাৎ আহমদীয়া মুসলমানরা মহান আল্লাহর জন্য যে কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে সদা প্রস্তুত। তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারাটাকে আমরা আমাদের জন্য মহা সৌভাগ্য বলে মনে করি।

গত ২৮ মের মর্মান্তিক ঘটনা আহমদীয়া বিরোধী প্রথম হত্যাযজ্ঞ নয় এবং এটিই শেষ ঘটনাও নয়। এর এক সপ্তাহ আগেও এবং দুই দিন পরেও সেই দেশে আহমদীয়াদেরকে হত্যা করা হয়েছে। একটি ধর্মান্ধ উগ্রবাদী মহলের পক্ষ থেকে সেখানে আহমদীদের প্রাণনাশ করা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক-দু বছরের ঘটনাবলি যাচাই করে দেখলে দেখা যাবে। শিয়ালকোট, ফয়সালাবাদ, মান্ডি-বাহাউদ্দীন, করাচি ও সারগোদা অঞ্চলে বারবার নিরীহ আহমদীয়াকে শহীদ করা হয়েছে। মোঙ্গ রসূল ও ঘাটালিয়া গ্রামে নামাজরত আহমদীয়াদেরকে স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করে হত্যা করার ঘটনায় অনেক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বিচার কাজ এক বিন্দু্ও এগোয়নি। কিন্তু এবারের ন্যায় প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশকে ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ করে এত অধিক সংখ্যায় আহমদীয়াদেরকে নির্বিচারে হত্যা করার ও আহত করার ঘটনা এই প্রথম। আত্মঘাতী সন্ত্রাসীদের অন্তত দুজনকে জীবিত অবস্থায় আহমদীয়া মুসলি্লরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। এদের একজন আহত অবস্থায় ছিল। লাহোরের জিন্নাহ হাসপাতালে চিকিৎসারত থাকা অবস্থায় ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা এই আহত সন্ত্রাসীকে উদ্ধার করার জন্য অথবা হত্যা করার উদ্দেশ্যে গভীর রাতে সেই হাসপাতালে আবার আক্রমণ চালায়। এবারের হামলায় কর্তব্যরত পুলিশসহ ১২ জন নিহত হয়।

পাকিস্তানের পরিস্থিতি কতটুকু ভয়াবহ সেটা এ ঘটনা যাচাই করলেই বোঝা যায়। মাত্র দু'দিন আগে দুই শতাধিক মানুষ হতাহত করার পর দু'দিন যেতে না যেতেই আবার সরকারি হাসপাতালে আক্রমণ চালানোর মতো শক্তি ও দুঃসাহস কোথা থেকে এই জঙ্গিরা পায় তা আমাদের বোধগম্য নয়। তবে এতটুকু বুঝি, গরিব ও দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের মাদ্রাসায় পড়ানোর সুযোগে একটি উগ্র মৌলবাদী চক্র তাদের মগজ ধোলাই করার কাজে ব্যস্ত থাকে। আত্মঘাতী বোমাবাজির মাধ্যমে তাদেরকে জান্নাতের হুর-পরী ও মহানবী (সা.)-এর নৈকট্য লাভের লোভ ও আশা দিয়ে এমনভাবে ধর্মান্ধ বানানো হয় যার কারণে সেই অভাবী ছেলেদের জন্য ইহকালীন জীবনযাপনের চেয়ে পরকালের যাত্রাটাই অধিক আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। দুঃখ হয় এই নিঃসহায় অজ্ঞদের জন্য। যেক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা করাটাই নিষিদ্ধ সেক্ষেত্রে আত্মঘাতী বোমাবাজ হয়ে এবং নিরীহ মানুষদের হত্যা করে কীভাবে মহানবী (সা.)-এর সানি্নধ্য লাভ করা যায় আর তাদের কল্পিত হুর-পরী লাভ করা যায় এটা তারা ভেবে দেখার ক্ষমতা বা যোগ্যতাও রাখে না। যারা তাদের এসব উগ্র ধর্মান্ধতা ও 'জান্নাত' লাভের শিক্ষা দেন তারা নিজেরা কিন্তু কখনও জান্নাতে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন না বা তাদের নিজ সন্তান-সন্ততিকে জান্নাতে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত হন না। গরিব নিঃস্ব ছাত্রদেরকে কল্পিত জান্নাতের স্বপ্ন দেখিয়েই তারা নিজেদের দায়-দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সুধীবৃন্দ! পাকিস্তান নামক দেশটিতে সুনি্নরা আক্রান্ত হচ্ছে, শিয়ারা আক্রান্ত হচ্ছে, হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে, যিকরীরাও হচ্ছে। কিন্তু আহমদীয়া-নির্যাতনের সঙ্গে এগুলোর একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আহমদীয়াদের বিরুদ্ধে সেই দেশে এমন সব আইন পাস করা বা প্রনয়ণ করা হয়েছে যেগুলো আহমদীয়া নির্যাতনকে এক ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা জোগায়। এরই সুযোগে এবং ছত্রছায়ায় সেখানে যুগ যুগ ধরে আহমদীয়ারা বারবার আক্রান্ত হচ্ছে। আবার এই ছত্রছায়ায় সেখানে উগ্র-ধর্মান্ধদের ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৪ সালে ৭২টি ফের্কার প্রতিনিধি সেজে কিছু কিছু উগ্র মৌলানাদের চাপের মুখে পাকিস্তান পার্লামেন্টে আহমদীয়াদেরকে 'সরকারিভাবে অমুসলমান' ঘোষণা করা হয়। আহমদীয়াদেরকে 'সরকারি কাফের' আখ্যা দেয়ার এই প্রহসনের প্রেক্ষাপট কি ছিল বা তদানীন্তন ভুট্টো সরকারের রূপ বিশ্লেষণ করা সেখানকার নাগরিকদের কাজ। তবে বিশ্ব-বিবেকের জানার জন্য সেই দেশেরই একজন ভুট্টো অনুসারীর স্বীকারোক্তি এখানে উপস্থাপন করা সমীচীন হবে বলে মনে করি। আহমদীয়াদের সে দেশে 'সরকারি কাফের' ঘোষণার দেড় মাস পরে এক নির্বাচনী প্রচারণায় পাঞ্জাব প্রদেশের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী হানিফ রামে'র বক্তব্য পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার ২৫ অক্টোবর, ১৯৭৪-এর সংখ্যায় এভাবে প্রকাশিত হয়েছে : 'এ বিষয়ে রামে এক শ্রেণীর উলামার তিব্র সমালোচনা করেন, যারা ৯০ বছর পুরনো কাদিয়ানী ইস্যুটিকে সমাধান করে দিলে ভুট্টোর জুতো নিজেদের দাড়ি দিয়ে পলিশ করে দিবেন বলে বলেছিলেন। বাস্তবতা প্রমাণ করে দিয়েছে, একমাত্র পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি-অনুবাদক) এবং জনাব ভুট্টো এ সমস্যা সমাধানে আন্তরিক ছিলেন, অথচ এসব আলেম-উলামা এবং বিরোধী দলের নেতারা এটাকে কেবল তাদের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করছিলেন।'

'সরকারি কাফের' ঘোষণার পথ ধরে একজন সামরিক জান্তা ১৯৮৪ সালে আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে নিজেকে 'খাঁটি ইসলাম সেবক' প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। ২৬ এপ্রিল ১৯৮৪ সালের যুগ-ধিকৃত অর্ডিন্যান্স নম্বর ২০ প্রণয়ন করে তিনি আহমদীয়াদেরকে এবার কাফের 'বানানোর' ব্যবস্থা করলেন। তার প্রণিত আইন অনুযায়ী, কোন আহমদীয়া মসজিদকে মসজিদ বলতে পারবে না, নামাজের জন্য আজান দিতে পারবে না। নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। নিজেকে মুসলমান হিসেবে প্রকাশ করতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি কেউ এসব কাজ করে তাহলে তার জন্য তিন বছরের কারাদ- বা জরিমানা অথবা উভয় ধরনের দ- রাখা হলো। একজন মুসলমান কীভাবে এসব ছাড়া থাকতে পারে? একজন মুসলমান নিজেকে মুসলমান প্রকাশ না করে কীভাবে থাকতে পারে? ব্যস আরম্ভ হয়ে গেল আহমদীয়াদের ধরপাকড়। এই সুযোগ গ্রহণ করে ধর্ম ব্যবসায়ী চক্র নিজেদের প্রভাব ও দাপট বিস্তার করা আরম্ভ করে এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে। আর আজ এই উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে পাকিস্তানের সাধারণ নিরীহ মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জিম্মি হয়ে আছে। প্রতিদিন ধর্মান্ধদের হাতে সেখানে মানুষ মারা পড়ছে। আজ পাকিস্তানের পুলিশ হেডকোয়ার্টারস এবং সেনানিবাসগুলোও এদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ নয়। তাই দেখা যাচ্ছে, যে বিষয়টিকে উগ্র মৌলবাদীরা সমস্যার সমাধান বলেছিল সেটা প্রকৃতপক্ষে সমাধান ছিল না বরং তা ছিল উগ্র-ধর্মান্ধদের সমাজে অনুপ্রবেশের ওপেন লাইসেন্স।

এখানে উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে উগ্র-মৌলবাদী ও জঙ্গিদের উত্থানের পেছনে কোন না কোনভাবে পাকিস্তানি জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে বারবার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। পাকিস্তান আজ সন্ত্রাসী জন্মদানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

পাকিস্তান সরকার যদি এসব মানবতা-বিরোধী আইন প্রত্যাহার করার বিষয়ে কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয় তাহলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দুরবস্থা ও নৈরাজ্য দূর হবে আর আঞ্চলিক শান্তি ও সৌহার্দ অনেকটা উন্নত হবে এবং বিশ্বে শান্তি ফিরে আসবে।

০৮/০৬/২০১০

0 comments:

Post a Comment